আড়াই বছর আগে থেকেই পরিবর্তন শুরু হয় মেজবা উদ্দিনের

 
Written By Sanjir Habib On Jan-16th, 2018

সুত্র : প্রথম আলো
তারিখ : ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

আড়াই বছর আগে থেকেই পরিবর্তন শুরু হয় মেজবা উদ্দিনের। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা বাদ দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন। সালাফি মতাদর্শ গ্রহণ করে সেই রীতিতে ধর্মকর্ম পালন করতে থাকেন। দুই মাস আগে মা ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ফোন করে বিদায় নেন। এরপর থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন ২৬ বছরের এই যুবক।

রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়ায় গত শুক্রবার ভোরে র‍্যাবের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত তিন যুবকের একজন এই মেজবা। র‍্যাব বলছে, মেজবাসহ নিহত তিনজন নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর তাঁদের হামলার পরিকল্পনা ছিল।

তবে পরিবারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, মেজবা স্ত্রী ও এলাকার ঘনিষ্ঠ দু-একজনকে নিজ মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তখন তাঁদের মুঠোফোনে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিভিন্ন ভিডিও বার্তা দেখান।

মেজবার বাড়ি কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার বাদুয়ারা গ্রামে। বাবা এনামুল হক ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে মেজবা চতুর্থ। পড়াশোনা করেছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। এরপর ২০০৭ সালে চলে আসেন ঢাকায়। কাজ করেন গাড়ির চাকা সারাইয়ের বিভিন্ন দোকানে। পরে সায়েদাবাদ এলাকায় নিজেই চাকা সারাইয়ের দোকান দেন।

মেজবার বাবা, মা, স্ত্রী ও এক ভাইকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র‍্যাব। তাই তাঁদের সঙ্গে গতকাল পর্যন্ত যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে মুঠোফোনে মেজবার ছোট ভাই এবং সায়েদাবাদ এলাকায় তাঁর সহকর্মী ও বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনায় মেজবার আচরণ ও চলাফেরায় হঠাৎ পরিবর্তনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে।

গতকাল সোমবার দুপুর ১২টার দিকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গেলে দেখা হয় মেজবার কয়েকজন বন্ধু ও সহকর্মীর সঙ্গে। তখনো তাঁরা জানতেন না তাঁর মৃত্যুসংবাদ। মেজবা দীর্ঘদিন এই বাস টার্মিনালেই তাঁর চাকা সারাইয়ের দোকান ছিল। প্রায় ১০ মাস আগে মো. জসিম নামের তাঁরই আরেক বন্ধুর কাছে দোকান বিক্রি করে দিয়ে জনপথের মোড়ে চলে যান। সেখানে নতুন দোকান দেন।

মেজবার সঙ্গে জসিমের পরিচয় ১০ বছর আগে। মেজবার মধ্যে যে পরিবর্তন হচ্ছিল, তা অনেকটা কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। জসিম বলেন, আগে মেজবা সারাক্ষণ গান শুনতেন। তাঁর কানে হেডফোন সারা দিনই লাগানো থাকত। বাসাবো বৌদ্ধমন্দিরের পাশের মাঠ এবং ধূপখোলা মাঠে তাঁরা একসঙ্গে ক্রিকেট খেলতেন। বিভিন্ন সময়ে একাধিক মেয়ের সঙ্গে প্রেমও করেন। দুই-আড়াই বছর আগে হঠাৎ মেজবার মধ্যেপরিবর্তন শুরু হয়। দাড়ি রাখেন। নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করেন। নামাজ পড়ার ধরন একটু অন্য রকম ছিল।

মেজবার পরিবারের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের মাঝামাঝি থেকে তাঁর মধ্যে পরিবর্তন আসে। তিনি সালাফি মতাদর্শ গ্রহণ করেন, তাঁদের মতো করে নামাজ পড়া শুরু করেন।

সালাফি মতাদর্শীরা বাংলাদেশে কোথাও ‘ওহাবি’ কোথাও ‘আহলে হাদিস’ নামে পরিচিত। মুসলিম বিশ্বে ওহাবি বা সালাফি মতাদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে সৌদি রাজপরিবার পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে বলে প্রচার আছে। বাংলাদেশে মুসলমানদের অধিকাংশই হানাফি মাজহাবের অনুসারী। জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের মতে, যাঁরা পারিবারিক সূত্রে নয়, নতুন করে সালাফি হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে উগ্রতা বেশি।

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের গ্যাসমিস্ত্রি সুজন হাওলাদারও কাছ থেকে দেখেছেন মেজবাকে। তিনি বলেন, একবার মেজবা বললেন তাবলিগে যাচ্ছেন। সেখান থেকে ফেরার পর থেকেই জোরেশোরে ধর্মকর্ম শুরু করেন। মুঠোফোনে তিনি সারাক্ষণ ওয়াজ জাতীয় কিছু একটা শুনতেন। সাধারণ মানুষ ধর্ম নিয়ে যে ধরনের কথা বলেন, মেজবার কথাগুলো ছিল এর চেয়ে একটু ভিন্ন।

মেজবা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন, এ কারণেই র‍্যাবের গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, এ কথা জানানোর পর তাঁর একসময়ের বন্ধু জসিম বলেন, মেজবা তাঁর কাছে দোকান বিক্রি করে দেওয়ার পর একদিন তিনি টাকা রাখার বাক্সের নিচে দুটো চাকু দেখতে পান। জসিমের ভাষায় ‘ভয়ংকর চাকু’। তিনি তখন মেজবাকে দ্রুত সেগুলো সেখান থেকে নিয়ে যেতে বলেছিলেন।

মেজবা সর্বশেষ গত বছরের অক্টোবরে আরও দুই যুবককে সঙ্গে নিয়ে কুমিল্লায় গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। তাঁদের তিনি তাঁর বন্ধু পরিচয় দেন। মেজবার ছোট ভাই মো. জাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, মেজবার দুই বন্ধু সারা দিন ঘরের মধ্যেই থাকতেন। তাঁদের তিনি আগে কখনো দেখেননি। দু-তিন দিন পর তাঁরা বাড়ি থেকে চলে যান। এরপর আরও পাঁচ-ছয় দিন থেকে মেজবাও ঢাকায় চলে যান।

র‍্যাব মেজবার মা ও স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। গতকাল র‍্যাব জানায়, ওই দুই যুবক ছয় দিন ছিলেন তাঁদের বাড়িতে। তাঁদের পরিচয় জানতে চাইলে মেজবা বলেছিলেন, তাঁরা মায়ের পেটের ভাইয়ের চেয়েও আপন।

র‍্যাব জানায়, গত বছরের ২০ অক্টোবর মেজবা সর্বশেষ বাড়ি যান। ২৬ অক্টোবর স্ত্রী ও পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেন। ১০ নভেম্বরের পর থেকে মেজবা পরিবারের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এর ১৫ থেকে ২০ দিন আগে স্ত্রী ও মাকে ফোন করে ক্ষমা চান এবং জান্নাতে দেখা হবে বলে শেষ বিদায় নেন। তখন স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা বলে জানালে মেজবা জানান, তিনি আল্লাহর রাস্তায় যাচ্ছেন। এরপর ১৯ ডিসেম্বর পরিবার ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করে।

সায়েদাবাদ জনপথের যে মোড়ে মেজবার সর্বশেষ দোকান ছিল, সেখানে এখন চায়ের দোকান। দোকানের মালিক আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নিরুদ্দেশ হওয়ার কয়েক দিন পর তাঁকে ফোন করেন মেজবা এবং দোকানটি কিনবেন কি না জানতে চান। তিনি আগ্রহী বলে জানালে মেজবা বলেন, তিনি ‘জামাতে’ আছেন, শেষ হলে ফিরে আসবেন। এরপর মেজবা আর যোগাযোগ করেননি। ১ জানুয়ারি মেজবার বাবা ও ভাই এসে তাঁর দোকানের জিনিসপত্র এবং দোকান বিক্রি করে যান।