হযরত ‘আয়িশার (রা) সর্বমোট বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা দুই হাজার দুইশো দশ (২২১০)।

 
Written By Sanjir Habib On Jan-9th, 2018

হযরত ‘আয়িশার (রা) সর্বমোট বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা দুই হাজার দুইশো দশ (২২১০)। তার মধ্যে সহীহাইন-বুখারী ও মুসলিমে ২৮৬টি হাদীস সংকলিত হয়েছে। ১৭৪টি মুত্তাফাক আলাইহি, ৫৩টি শুধু বুখারীতে এবং ৬৯টি মুসলিমে এককভাবে বর্ণিত হয়েছে। এই হিসেবে বুখারীতে সর্বমোট ২২৮টি এবং মুসলিম ২৪৩টি হাদীস এসেছে। এছাড়া হযরত ‘আয়িশার (রা) অন্য হাদীসগুলি বিভিন্ন গ্রন্থে সনদ সহকারে সংকলিত হয়েছে। ইমাম আহমাদের (রা) মুসনাদের ৬ষ্ঠ খন্ডে (মিসর) হযরত ‘আয়িশার (রা) বর্ণিত সকল হাদীস সংকলিত হয়েছে। মুসলিম উম্মার নিকট হযরত ‘আয়িশার (রা) যে উঁচু মর্যাদা ও বিরাট সম্মান তা তাঁর অধিক হাসীদ বর্ণনার জন্য নয়, বরং হাদীসের গভীর ও সূক্ষ্ণ তাৎপর্য এবং মূল ভাবধারানুধাবনই প্রধান কার। সাহাবীদের মধ্যে অনেকেই এমন আছেন যাঁদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা খুবই অল্প। কিন্তু তাঁরা উঁচু স্তরের ফকীহ সাহাবীদের অন্তর্গত। যাঁরা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাণরি মূল তাৎপর্য অনুধাবন না করে যা কিছু শুনেছেন তাই বর্ণনা করে দিয়েছেন, তাঁদের বর্ণনার সংখ্যা বেশি। আমরা দেখতে পাই যে, সকল সাহাবী বেশি হাদীস বর্ণনাকরী হিসেবে প্রসিদ্ধ তাঁদের মধ্যে কেবল হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আববাসি (রা) ও হযরত ‘আয়িশা (রা) ফকীহ ও মুজতাহিদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। কথিত আছে শরীয়াতের যাবতীয় আহকামের এক-চতুর্থাংশ তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাই আল্লামা জাহাবী বলেছেনঃ

-রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফকীহ (গভীর জ্ঞানসম্পন্ন) সাহাবীরা তাঁর কাছ থেকে জানতেন। একদল লোক তাঁর নিকট থেকেই দীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
বর্ণনার আধিক্যের সাথে সাথে দীনের তাৎপর্যের গভীর উপলব্ধি এবং হুকুম-আহকাম বের করার প্রবল এক ক্ষমতা হযরত ‘আয়িশার (রা) মধ্যে ছিল। তাঁর বর্ণনাসমূহের এ এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য যে, আহকাম ও ঘটনাবলী বর্ণনার সাথে সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর কারণও বলে দিয়েছেন। তাঁর বর্ণনার বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্য এখানে অন্যান্য রাবীর (বর্ণনাকারী) বর্ণনার সাথে একটি সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক আলোচনা উপস্থাপন করা হলো।

জুম‘আর দিন গোসল করা সম্পর্কে সহীহ বুখারীতে হযরত ‘আবদুল্লাহর ইবন ‘উমার (রা), হযরত আবু সা‘ঈদ খুদরী (রা) ও হযরত ‘আয়িশা (রা) থেকে বর্ণনা এসেছে। এখানে তিনজনের বর্ণনার নমুনা দেয়া হলো। হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার বলেনঃ

-আমি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনেছি, তোমাদের যে ব্যক্তি জুম‘আয় আসে, সে যেন অবশ্যই গোসল করে আসে।
হযরত আবু সা‘ঈদ খুদরী (রা) বলেনঃ

-রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ প্রত্যেক বালিগ ব্যক্তির উপর জুম‘আর দিনের গোসল ওয়াজিব।

একই বিষয়ে হযরত ‘আয়িশার (রা) বর্ণনা নিম্নরূপঃ

-মানুষ নিজেদের ঘর-বাড়ী থেকে এবং মদীনার বাইরের বসতি থেকে আসতো। তারা ধুলো বালির মধ্য দিয়ে আসতো। এতে তারা ঘামে ও ধুলো-বালিতে একাকার হয়ে যেত। একবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার নিকট অবস্থান করছেন, এমন সময় তাদেরই এক ব্যক্তি তাঁর কাছে আসে। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ তোমরা যদি এই দিনটিতে গোসল করতে তাহলে ভালো হতো।
হযরত ‘আয়িশার (রা) অন্য একটি বর্ণনা এভাবে এসেছেঃ

-লোকেরা নিজ হাতে কাজ করতো। যখন তারা জুম‘আর নামাযে যেত তখন সেই অবস্থায় চলে যেত। তখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা যদি গোসল করতে তাহলে ভালো হতো।

আমরা উপরের একই বিষযের তিনটি বর্ণনা রক্ষ্য করলাম। কি কারণে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুম‘আর দিনে গোসলের নির্দেশ দেন, তা হযরত ‘আয়িশার (রা) স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন-যা অন্য দুইটি বর্ণনায় নেই।

একবার হযরতত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ দিলেন, কুরবানীর গোশত তিন দিনের মধ্যে খেয়ে শেষ করতে হবে। তিন দিনের বেশি রাখা যাবে না। হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার (রা) ও হযরত আবু সা‘ঈদ খুদরী (রা)সহ আরো অনেক সাহাবী এই নির্দেশকে চিরস্থায়ী বলে মনে করতেন। তাঁদের অনেকে এ ধরনের কথাই লোদের বলতেন। কিন্তু হযরত আয়িশা (রা) এটাকে চিরস্থায়ী বা অকাট্য নির্দেশ বলে মনে করতেন না। তিনি এটাকে একটা সাময়িক নির্দেশ বলে বিশ্বাস করতেন।
বিষয়টি তিনি বর্ণনা করছেন এভাবেঃ

-আমরা কুরবানীর গোশত লবণ দিয়ে রেখে দিতাম। মদীনায় আমরা ঐ গোশত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে খাওয়া জন্য উপস্থাপন করতাম। তিনি বললেনঃ তোমরা এই গোশত তিন দিন ছাড়া খাবে না। এটা কোন চূড়ান্ত নিষেধাজ্ঞা ছিলনা। বরং তিনি চেয়েছেন মানুষ যেন এই গোশত থেকে কিছু অন্যদেরকেও খেতে দেয়।

হযরত ‘আয়িশার (রা) অন্য একটি হাদীস যো ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন, তাতে তিনি এই নিষেধাজ্ঞাও প্রকৃত কারণ বলে দিয়েছেন। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলোঃ উম্মুল মু’মিনীন! কুরবারীন গোশত তিন দিনের বেশি খাওয়া কি নেষেধ! তিনি বলেনঃ

-না। তবে সেই সময় কুরবানী করার লোক কম ছিল। এজন্য তিনি চান, যারা কুরবানী করতে পারেনি তাদেরকেও যেন ঐ গোশত খেতে দেয়।

ইমাম আহমাদ হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ

-এটা সঠিক নয় যে, কুরবানীর গোশত তিন দিন পর খাওয়া যাবে না। বরং সেই সময় খুব কম লোক কুরবানী করতে পারতো। এ কারণে তিনি এই নির্দেশ দেন যে, যারা কুরবানী করে তারা যেন তাদেরকে গোশত খেতে দেয় যারা কুরবানী করতে পারেনি।

ইমাম মুসলিম এই হাদীসটি একটি তথ্যের আকারে বর্ণনা করেছেন। যেমন, এক বছর মদীনার আশে-পাশে এবং গ্রাম এলাকায় অভাব দেখা দেয়। সেবার তিনি এই হুকুম দেন। পরের বছর যখন অভাব থাকলো না তখন ঐ হুকুম রহিত করেন।হযরত সালামা ইবন আকওয়া (রা) থেকেও এ ধরনের একটি বর্ণনা আছে।
কা‘বা ঘরে এক দিকের দেওয়ালের পরে কিছু জায়গা ছেড়ে দেয়া আছে, যাকে ‘হাতীম’ বলে। তাওয়াফের সময় ‘হাতীমকে’ বেষ্টনীর মধ্যে নিয়েই তাওয়াফ করতে হয়। মানুষের অন্তরে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, যেটি কা‘বার অংশ নয়, সেটিও তাওয়াফ করতে হবে কেন? হয়তো অনেক সাহাবী রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট এই প্রশ্নের উত্তর চেয়ে থাকবেন। কিন্তু হাদীসের গ্রন্থসমূহে তাঁদের থেকে তেমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। আমরা হযরত ‘আয়িশার (রা) বর্ণনা থেকে এই প্রশ্নের উত্তর পাই। তিনি বলেন, আমি প্রশ্ন করিঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই দেওয়ালও কি কা‘বা ঘরের অন্তর্গত? বললেনঃ হ্যঁ! বললামঃ তাহলে নির্মাণের সময় লোকেরা এটাকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিল না কেন? বললেনঃ তোমার স্বাজাতির হাতে পুঁজি ছিল না। তাই এটুকু বাদ দেয়। আবার প্রশ্ন করলামঃ তা কা‘বার দরজা এত উঁচুতে কেন? বললেনঃ এজন্য যে, সে যাকে ইচ্ছা ভিতরে যেতে দেবে, আর যাকে ইচ্ছা বাধা দেবে।

হযরত ‘উমার (রা) বলেন, ‘আয়িশার (রা) বর্ণনা সঠিক হলে বুঝা যায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেদিকেও স্তম্ভ দুইটি এই কারণে চুমো দেননি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন জানতেন যে, কা‘বা ঘর তার মূলভিত্তির উপর সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত নেই, তখন হযরত ইবরাহীমের (আ) শরীয়াতের পুনরুজ্জীবনকারী হিসেবে তাঁর উত্তরাধিকারী নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানা থাকার ব্যাপারে কোন সন্দোহ নেই। তাই তিনি হযরত ‘আয়িশার (রা) প্রশ্নের উত্তরে বলেছেনঃ আয়িশা! তোমার কাওম যদি তাদের কুফরীর সময়কালের নিকটবর্তী না হতো তাহলে আমি কা‘বাকে ভেঙ্গে আবার ইবরাহীমের মূল ভিত্তির উপর নির্মাণ করতাম। যেহেতু সাধারণ আরববাসী সদ্য ইসলাম গ্রহণ করেছেন, এমতাবস্থায় নতুন করে কা‘বা গৃহ নির্মাণ করলে তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারতো, এই আশঙ্কায় তা করা হয়নি। এই হাদীস থেকে জানা যায় যে, অধিকতর কোন কল্যাণের ভিত্তিতে যদি শরীয়াতের কোন কাজের বাস্তাবায়নে বিলম্ব করা হয় তাহলে তা তিরস্কারযোগ্য হবে না। তবে শর্ত হচ্ছে সেই কাজটির বাস্তবায়ন যদি শরীয়াত তাৎক্ষণিকভাবে দাবী না করে।
হযরত ‘আয়িশার (রা) এই বর্ণনার ভিত্তিতে তাঁর ভাগ্নে হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা) স্বীয় খিলাফতকালে কা‘বা ঘর বাড়িয়ে ইবরাহীমের (আ) মূল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত ইবন যুবাইরের (রা) শাহাদাতের পর খলীফা ‘আবদুল্লাহ মালিক যখন পুনরায় মক্কার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন তখন তিনি এ ধারণার ভিত্তিতে যে, ‘আবদুল্লাহ (রা) এ কাজ তাঁর নিজের ইজতিহাদ থেকে করেছেন, ভেঙ্গে ফেলেন এবং পূর্বের মত তৈরি কনের। কিন্তু তিনি যখন জানতে পারলেন ‘আবদুল্লাহ (রা) নিজের ইজতিহাদ থেকে নয়, বরং উম্মুল মু’মিনীনের এ বর্ণনার ভিত্তিতে করেছেন, তখন তিনি নিজের এই কাজের জন্য ভীষণ লজ্জিত ও অনুতপ্ত হন।

হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকালের পর তাঁকে কোথায় দাফন করা হবে তা নিয়ে বিশিষ্ট সাহাবীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। একটি বর্ণায় এসেছে, হযরত আবু বকর (রা) তখন বলেন, নবীরা যেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সেখানেই দাফন করা হয়। এ কারণে রাসূলে কারীমকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) ঘরে, যেখানে মৃত্যুবরণ করেন, দাফন করা হয়। কিন্তু এর আসল কারণ হযরত ‘আয়িশার (রা) বর্ণনায় পাওয়া যায়। তিনি বলেনঃ
-রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তিম রোগশয্যায় বলেন, আল্লাহ ইহুদী ও নাসারাদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করুন। তারা তাদের নবীদের কবরসমূহকে উপাসনালয় বানিয়ে নিয়েছে। ‘আয়িশা (রা) বলেন, যদি এমন আশঙ্কা না থাকতো তাহলে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবর মাঠেই হতো। কিন্তু তিনি কবরকে সমজিদ বানানোর ব্যাপারে শঙ্কাবোধ করেন।
মূলতঃ রাসূরুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই শঙ্কা প্রকাশের কারণেই তাঁকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের স্থলেই দাফন করা হয়।

এমনি ভাবে হিজরাতের একটি স্পষ্ট ব্যাখ্যাও বুখারী বর্ণিত ‘আয়িশার (রা) একটি হাদীস থেকে পাওয়া যায়। সাধারণভাবে হিজরাত বলতে মানুষ বুঝতো নিজের জন্মস্থান ত্যাগ করে মদীনায় এসে বসবাস করা। কিন্তু তিনি বলেন, এখন আর হিজরাত নেই। হিজরাত তো তখন ছিল যখন মানুষ নিজেদের দীন-ধর্মকে বাঁচানোর জন্য প্রাণের ভয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলুলের নিকট আসতো। এখন তো আর সে অবস্থা নেই। সুতরাং প্রকৃত হিজরাতও হবে না। এ কারণে ইবন উমার (রা) বলতেনঃ মক্কা বিজয়ের পর আর হিজরাত নেই।

মুহাদ্দিসীন ও জারাহ ও তা‘দীল (সমালোচনা ও মূল্যায়ন) শাস্ত্রবিদদের মতে হযরত ‘আয়িশার (রা) বর্ণিত হাদীসসমূহের মধ্যে ভুল-ভ্রান্তি তুলনামূলকভাবে খুব কম। এর বিশেষ কারণও আছে। সাধারণ সাহাবীরা হয়তো একবার রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন কথা শুনতেন বা কোনকাজ করতে দেখতেন, তারপর বুবহু সেই কথা বা কাজের বর্ণনা অন্যদের নিকট দিতেন। এক্ষেত্রে হযরত ‘আয়িশার (রা) রীতি ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন কথা বা ঘটনা ভালোমত বুঝতে পারতেন, অন্যের নিকট বর্ণনা করতেন না। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন কথা বা আচরণ বুঝতোক্ষম হলে তিনি বারবার প্রশ্ন করে তা বুঝে নিতেন। হাদীসের গ্রন্থসমূহে তাঁর এ ধরনের বহু জিজ্ঞাসা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু অন্যরা এ সুযোগ খুব কমই পেতেন।

যে সকল হাদীস তিনি সরাসরি শোনেননি, বরং অন্যদের মাধ্যমে শুনেছেন, সেগুলির বর্ণনার ক্ষেত্রে দারুণ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। চূড়ান্ত রকমের যাচাই-বাছাই, বিচার-বিশ্লেষণ ও খোঁজ-খবর নেওয়ার পর পূর্ণ আস্থা হলে তখন বণৃনা করতেন। একবার প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুলত্মাহ ইবন আমর ইবনুর আ‘স (রা) তাঁকে একটি হাদীস শোনালের। একবছর পর তিনি যখন আসলেন তখনহযরত আয়িশা (রা) এক ব্যক্তিকে তাঁর নিকট পাঠালেন সেই হাদীসটি আবার শুনে আসার জন্য। আবদুল্লাহ (রা) কোনরকম কম-বেশি ছাড়াই পূর্বের মত হাদীসটি হুবহু বর্ণনা কনের। লোকটি ফিরে এসে হাদীসটি আয়িশাকে (রা) শোনান। তিনি তখন মন্তব্য করেন, আল্লাহর কসম, ইবন আমরের কথা স্মারণ আছে।

এই মূলনীতির ভিত্তিতে তিনি যদি কারও নিকট থেকে কোন বর্ণনা গ্রহণ করতেন, আর কেউ যদি সেটি শোনার ইচ্ছা নিয়ে তাঁর কাছে আসতো, তাঁকে মূর বর্ণনাকারীর নিকট পাঠিয়ে দিতেন। আসলে উদ্দেশ্য হতো হাদীসটির বর্ণনা সূত্রের মাঝখানের মাধ্যম যতখানি সম্ভব কমিয়ে দেওয়া এবং আলী সনদে রূপান্তরিত করা। যেমন, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদে আসরের নামায আদায়ের পর ঘরে এসে সুন্নাত নামায আদায় করতেন। অথচ চূড়ান্ত নির্দেশ ছিল আসরের পরে আর কোন নামায নেই। কিছু লোক হযরত আয়িশার (রা) নিকট এক ব্যক্তিকে পাঠালো একথা জানার জন্য যে, তাঁর সূত্রে যে এই হাদীস বর্ণিত হচ্ছে, এর বাস্তবতা কতটুকু? তিনি বললেন, তোমরা উম্মু সালামার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। হাদীসটির আসল রাবী বা বর্ণনাকারী তিনিই। আর একবার এক ব্যক্তি তাঁকে মোযার উপর মাসেহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলেনঃ আলীর (রা) কাছে যাও। তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফরে সংগে থাকতেন।

হযরত ‘আয়িশা (রা) নিজের বর্ণনাসমূহকে যে কোন রকমের ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেমন যুক্ত রেখেছেন, তেমনিভাবে বহুক্ষেত্রে অন্যদের বর্ণনাসমূহও সংশোধন করে দিয়েছেন। তিনি তাঁর সমকালীনদের বর্ণনাসমূহের অতি তুচ্ছ ক্রটি-বিচ্যুতিও অত্যন্ত কঠোরভাবে পাকড়াও করতেন এবং সংশোধন করে দিতেন। মুহাদ্দিসদের পরিভাষায় যা ‘ইদরাক’ নামে পরিচিত।
হযরত ‘আয়িশা (রা) বিশ্বাস করতেন, কোন বর্ণনা আল্লাহর কালামের বিরোধী হলে তা সঠিক নয়। পরবর্তীকালে হাদীস শাস্ত্র বিশারদরা এটাকে হাদীস যাচাই বাছাইরের একটি অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এই মূলনীতির ভিত্তিতে হযরত ‘আয়িশা (রা) অন্যদের অনেক বর্ণনা সঠিক বলে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আর নিজের জ্ঞান অনুযায়ী সেই সব বর্ণনার প্রকৃত রহস্য ও ভাব বর্ণনা করেছেন। যেমনঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবন আববাস (রা), হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার (রা) এবং আরও কতিপয় সাহাবী বর্ণনা করেছেনঃ

অর্থাৎ, পরিবারের লোকদের কান্নার জন্য মৃত ব্যক্তিকে শাস্তি দয়ে হয়।’

হযরত ‘আয়িমাকে (রা) যখন এই বর্ণনাটি শোনানো হলো তখন তিনি তা মানতোস্বীকার করলেন। বললেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন কথা কক্ষনো বলেননি। ঘটনা হলো, একদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক ইহুদীর লাশের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, দেখলেন তার আত্মীয় স্বজনরা চিল্লাপাল্লা ও মাতম করতে আরম্ভ করেছে। তখন তিনি বলেনঃ এরা কান্নাকাটি করছে আর তার উপর শাস্তি হচ্ছে। ‘আয়িশার (রা) বক্তব্যের মর্ম হলো, শাস্তির কারণ কান্নাকাটি করা নয়। অর্থাৎ এরা মাতম করছে, আর ওদিকে মৃতব্যক্তির উপর অতীত কৃতকর্মের জন্য শাস্তি হচ্ছে। কারণ, কান্নাকাটি করা তো অন্যের কর্ম। আর অন্যের কর্মফল মৃত ব্যক্তি কেন ভোগ করবে? তাই তিনি বলেন, তোমাদের জন্য কুরাআনই যথেষ্ট। আল্লাহ বলেছেনঃ
কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না।

বর্ণনাকারী ইবন আবী মুলাইকা বলেন, হযরত ইবন ‘উমার (রা) হযরত ‘আয়িশার (রা) এমন বর্ণনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা যখন শুনলেন তখন কোন উত্তর দিতে পারেননি।

ইমাম বুখারী (রা) তাঁর সহীহ গ্রন্থের আল-জানায়িয’ অধ্যায়ে পৃথক একটি অনুচ্ছেদে হযরত ‘আয়িশার (রা) ও ইবন ‘উমারের (রা) বর্ণনা দুইটির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেছেন। তিনি বরেন, কান্নাকাটি ও মাতম করা যদি মৃত ব্যক্তির জীবিত অবস্থার অভ্যাস থেকে থাকে, আর সে যদি জীবদ্দশায় আপনজনদেরকেও এমন কাজ থেকে বিরত থাকার কথা না বরে থাকে তাহলে তাদের মাতমের আযাব তার উপর হবে। কারণ, তাদের শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব সে তাঁর জীবদ্দশায় পালন করেনি। আল্লাহ বলেনঃ
-হে ঈমানদার ব্যক্তিরা! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।

আর জীবদ্দশায় পরিবার-পরিজনকে যথাযথ শিক্ষাদান সত্ত্বে্ও যদি তারা মৃত ব্যক্তির জন্য মাতম করতে থাকে তাহলে সে ক্ষেত্রে আয়িশার (রা) মতই সঠিক। কারণ আল্লাহ তো বলেছেন, কেউ অপরের বোঝা বহন করব না।’ তিনি আরো বলেছেনঃ

-কেউ যদি তার গুরুভার বহন করতোন্যকে আহবান করে কেউ তা বহন করবে না- যদি সে নিকটবর্তী আত্মীয়ও হয়।

প্রখ্যাত ইমাম ও মুহাদ্দিস হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন মুবারাকও ইমাম বুখারীর মত বলেছেন। তবে কেউ কেউ ইমাম বুখারীর সামঞ্জস্য চেষ্টার প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন এভাবে-কেউ যদি জীবদ্দশায় পরিবার-পরিজনের সঠিক শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব পালন না করে থাকে, তাহলে মৃত্যুর পর সে দায়িত্ব পালন না করার অপরাধের শাস্তি ভোগ করবে। জীÿÿতদের অপরাধের শাস্তি ভোগ করবে কেন? মুজতাহিদদের মধ্যে ইমাম শাফি’ঈ ইমাম মুহাম্মদ ও ইমাম আবু হানীফা (রা) এই মাসয়ালায় হয়রত ‘আয়িশার (রা) মতের অনুসারী।

(collected from FB)